তারাপীঠ

তারাপীঠ: তন্ত্র সাধনার প্রাণকেন্দ্র ও আধ্যাত্মিক শক্তির আধার

By Meenakshi G on April 17, 2025

তারাপীঠ: তন্ত্র সাধনার প্রাণকেন্দ্র ও আধ্যাত্মিক শক্তির আধার

বাংলার ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ইতিহাসে তারাপীঠ একটি অপরিহার্য নাম। এটি শুধুমাত্র একটি মন্দির নয়, বরং একটি বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার স্থান। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় অবস্থিত এই শক্তিপীঠ, হিন্দুদের ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম। কিংবদন্তি অনুসারে, এখানে সতীর তৃতীয় নেত্র পতিত হয়েছিল। তাই এই স্থানটি শক্তির এক বিশেষ রূপ, মা তারা-র পূজার স্থান হিসেবে পরিচিত।

তারাপীঠের ইতিহাস ও পৌরাণিক ব্যাখ্যা

তারাপীঠের উৎপত্তির পেছনে রয়েছে বহু পৌরাণিক কাহিনি। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, সতী দেবীর শরীর যখন ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা খণ্ডিত হয়, তখন তাঁর তৃতীয় নেত্র এই স্থানে পতিত হয়। সেই কারণেই এই স্থানটি শক্তিপীঠ রূপে পরিগণিত হয়।

অন্যদিকে, তন্ত্র সাধনার এক বিশেষ ক্ষেত্র হিসেবে তারাপীঠ পরিণত হয়েছে সাধক বামাক্ষ্যাপার উপস্থিতির জন্য। বলা হয়, মা তারা স্বয়ং তাঁকে মাতৃস্নেহে গ্রহণ করেছিলেন এবং বহু অলৌকিক ঘটনায় তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন।

তারাপীঠের মন্দির স্থাপত্য ও বৈশিষ্ট্য

তারাপীঠের মন্দিরটি টেরাকোটা শিল্পে অলংকৃত একটি প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন। মা তারা-র বিগ্রহটি এক অপূর্ব রূপে প্রতিষ্ঠিত – মা কালোর মতো, মাথায় খুলি মালা, কোমরে মানুষের কঙ্কাল দিয়ে গঠিত বস্ত্র, মুখে রক্তমাখা জিভ। মা তারাকে এখানে মাতৃরূপে পূজা করা হয়, যদিও তাঁর রূপ যথেষ্ট ভয়ঙ্কর।

মন্দিরের নিকটে অবস্থিত বামাক্ষ্যাপার সাধনাস্থল এবং তাঁর সমাধি এই তীর্থস্থানের মহিমাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এই সমাধিস্থল থেকেই আজও বামাক্ষ্যাপা আধ্যাত্মিক শক্তি বিতরণ করেন।

তন্ত্রসাধনা ও তারাপীঠের বিশেষতা

তন্ত্রসাধনার মূল কেন্দ্র হিসেবে তারাপীঠ হিন্দুধর্মের গূঢ়তম ও আধ্যাত্মিক দিককে তুলে ধরে। বিশেষ করে, মহাকাল ও মহাশক্তির মধ্যে এক অভিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে এই সাধনা। তান্ত্রিক সাধনার উদ্দেশ্য কেবল আত্মোন্নতি নয়, বরং মহাশক্তির সঙ্গে একাত্মতা অর্জন।

সাধনার জন্য মধ্যরাত্রি এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়, কারণ ধারণা করা হয় এ সময়ে মা তারা সর্বাধিক প্রভাবশালী রূপে বিরাজ করেন। বহু সাধক এখনও এই সময়ে মা তারার কাছে বিশেষ পূজা ও যজ্ঞ সম্পন্ন করে থাকেন।

তারাপীঠে উৎসব ও রীতি-নীতি

তারাপীঠে সারা বছর ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে, তবে কালীপূজা ও অমাবস্যা তিথিতে এখানে এক অভাবনীয় জনসমাগম দেখা যায়। এই সময় বিশেষভাবে মা তারার আরতি, হোম যজ্ঞ ও পুষ্পাঞ্জলি অনুষ্ঠিত হয়। অনেক ভক্ত অন্নদানের আয়োজন করেন এবং রাত্রিযাপন করেন মন্দির প্রাঙ্গণে।

এছাড়া, তারাপীঠে গরু বলি দেওয়ার রীতি এখনও প্রচলিত, যা অনেক বিতর্কের সৃষ্টি করলেও, একাংশ ভক্ত একে পরম্পরার অংশ হিসেবেই দেখে থাকেন।

দর্শনার্থীদের জন্য গাইডলাইন

তারাপীঠে যেতে হলে প্রথমে বীরভূম জেলার রামপুরহাটে পৌঁছাতে হয়। কলকাতা থেকে ট্রেনে রামপুরহাট পৌঁছে তারপর অটো বা টোটো করে সহজেই মন্দিরে যাওয়া যায়। তারাপীঠে বিভিন্ন মানের হোটেল ও লজ পাওয়া যায়, যা যাত্রীদের জন্য সুবিধাজনক।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে, তবে মধ্যরাত্রিতে বিশেষ পূজার জন্য অনুমতি নিতে হয়। ভক্তদের শালীন পোশাক পরিধান ও মন্দিরের শৃঙ্খলা বজায় রাখা জরুরি।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় তারাপীঠ

বর্তমানে তারাপীঠ আধুনিক যোগাযোগ ও পর্যটন সুবিধার কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দর্শনার্থীদের কাছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সরকার মন্দিরের পরিকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।

তারাপীঠ এখন শুধুমাত্র তন্ত্রসাধনার ক্ষেত্র নয়, বরং ধর্মীয় পর্যটনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রও। অনেক গবেষক, ইতিহাসবিদ এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানী এখানে এসে মা তারার শক্তি ও তন্ত্রতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন।

উপসংহার

তারাপীঠ এক অদ্ভুত মিশ্রণ – ভক্তি, তন্ত্র, পৌরাণিকতা ও সংস্কৃতির। যারা আত্মিক উন্নয়নের খোঁজে রয়েছেন বা হিন্দু ধর্মের গূঢ় রূপগুলি বুঝতে চান, তাঁদের জন্য তারাপীঠ এক আদর্শ স্থান। মা তারার আশীর্বাদে এই স্থান আজও চিরজাগ্রত, চিরশক্তিময়।